ইসলামের শান্তিপূর্ণ দাওয়াতি আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত নাম “তাবলীগ জামাত”। এই আন্দোলনের অন্যতম বড় ও ঐতিহাসিক ঘটনা হলো “বিশ্ব ইজতেমা”—যা প্রতিবছর বাংলাদেশের টঙ্গীতে লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে একত্রিত করে। এই ব্লগে আমরা জানবো বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের সূচনা, বিশ্ব ইজতেমার উত্থান, এর বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব।
তাবলীগ জামাতের উৎপত্তি
তাবলীগ জামাতের জন্ম ভারতের মেওয়াতে (বর্তমান হরিয়ানা) ১৯২৬ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী (রহ.)। তিনি মুসলিম সমাজে ধর্মীয় উদাসীনতা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে ইসলামের মৌলিক আহ্বান “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” কে সামনে রেখে এক শান্তিপূর্ণ দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করেন।
তার উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মুসলমানদের দ্বীনের মৌলিক আমল—নামায, কালেমা, ইলম, দাওয়াত, ইখলাস এবং সময় আল্লাহর পথে ব্যয়—এই ছয় নীতিতে ফিরে আনা।
তাবলীগ জামাতের বাংলাদেশে আগমন
তাবলীগ জামাত বাংলাদেশে আসে ১৯৪০ এর দশকে। প্রাথমিকভাবে ঢাকার কয়েকটি মসজিদে এই আন্দোলন শুরু হয়। এরপর চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী সহ বিভিন্ন অঞ্চলে এর প্রসার ঘটে।
১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকার কাকরাইল মসজিদ তাবলীগ জামাতের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এই মসজিদই বর্তমানে বাংলাদেশের তাবলীগ জামাতের আন্তর্জাতিক মারকাজ।
বিশ্ব ইজতেমার সূচনা
১৯৪৬ সালে ঢাকায় প্রথম ইজতেমার আয়োজন হয়, যা ছিল তুলনামূলকভাবে ছোট। তবে ১৯৬৫ সালে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে প্রথমবারের মতো বড় আকারে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়।
এরপর থেকেই টঙ্গীর মাঠে প্রতিবছর জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৯৮০ এর দশক থেকে এটি আন্তর্জাতিক রূপ পায়।
বিশ্ব ইজতেমার বৈশিষ্ট্য
১. রাজনীতি-মুক্ত পরিবেশ
ইজতেমা কোনো রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক প্ল্যাটফর্ম নয়। এখানে শুধুই ইসলামের মৌলিক আহ্বান ও আত্মশুদ্ধির আলোচনা হয়।
২. বক্তৃতা ও বয়ান
দেশ-বিদেশ থেকে আসা আলেম ও দাঈগণ ঈমান, আমল, ও আখলাক বিষয়ে বয়ান দেন।
৩. গোটা বিশ্বের মুসলমানের অংশগ্রহণ
প্রতি বছর প্রায় ১২০+ দেশের মুসলমানেরা অংশগ্রহণ করেন। এতে তৈরি হয় এক বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ।
৪. আখেরি মোনাজাত
বিশ্ব ইজতেমার মূল আকর্ষণ হচ্ছে “আখেরি মোনাজাত”। লাখ লাখ মানুষ একসঙ্গে হাত তুলে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করেন—এটি এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য।
তাবলীগ জামাতের ৬ মূলনীতি
১. কালেমা – তাওহীদের ভিত্তি
২. নামায – ইসলামের স্তম্ভ
৩. ইলম ও জিকির – দ্বীন বুঝা ও অন্তরের পরিচ্ছন্নতা
৪. ইকরামুল মুসলিমীন – মুসলমানদের সম্মান
৫. ইখলাস – কাজ শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য
৬. দাওয়াত ও তাবলীগ – মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান
এই ছয় আমলের মাধ্যমে একজন মুসলমান ব্যক্তিগতভাবে ও সমাজিকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে।
তাবলীগ জামাত ও ইজতেমার ভূমিকা
-
ধর্মীয় উদাসীনতা দূর করা
-
আত্মশুদ্ধির সুযোগ তৈরি
-
দুনিয়াবিমুখ, আল্লাহভীরু মুসলমান তৈরি
-
দ্বীনি সংহতি এবং মুসলিম ঐক্য রক্ষা
সমালোচনা ও বিভেদ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাবলীগ জামাতে কিছু বিভেদ দেখা গেছে। বিশেষ করে দুই পক্ষ—একটি মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারী, অন্যটি বাংলাদেশের শুরা কমিটি।
এই মতবিরোধ কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি করলেও, সাধারণ জনগণের মাঝে দাওয়াতি চেতনা কমেনি।
তাবলীগ জামাত এবং বিশ্ব ইজতেমা শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি দাওয়াতি আলোকবর্তিকা। রাজনীতি মুক্ত, সহিষ্ণু এবং আত্মশুদ্ধিমূলক এ আন্দোলন মুসলমানদের অন্তরের পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশে ইসলামিক দাওয়াতি চেতনাকে জাগ্রত করতে ইজতেমা এক অনন্য দৃষ্টান্ত।