পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ব্যক্তি নেই যার জীবন এত নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত, অনুসৃত ও অনুকরণীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেভাবে হয়েছে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের। তিনি ছিলেন মানবজাতির জন্য আল্লাহর পাঠানো সর্বশেষ রাসূল, যাঁর জীবন ও চরিত্র হচ্ছে মানবতার আদর্শ পথ। তাঁর জীবনী—যাকে ‘সীরাতুন্নবী’ বলা হয়—জানার গুরুত্ব শুধু ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সকল ক্ষেত্রেই অপরিহার্য।
কুরআনের দৃষ্টিতে রাসূল (সা.)-এর জীবনের গুরুত্ব
আল্লাহ তাআলা কুরআনে ঘোষণা করেছেন:
“لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ”
“নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।” (সূরা আল-আহযাব, আয়াত ২১)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, রাসূল (সা.)-এর জীবন কেবল নিছক ইতিহাস নয়, বরং আমাদের জীবনের প্রতিটি দিকের জন্য একটি আদর্শ।
রাসূল (সা.)-এর জীবনের ধাপসমূহ
তাঁর জীবন মোটামুটি চারটি ধাপে ভাগ করা যায়:
- শৈশব ও কৈশোর — মক্কার এক উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন কিন্তু দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এতিম হয়েই বড় হন।
- নবুওয়তের পূর্ববর্তী জীবন — “আল-আমীন” হিসেবে খ্যাত হন। সমাজে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
- নবুওয়তের ১৩ বছর মক্কা পর্ব — দাওয়াত, বিরোধিতা, হিজরতের প্রস্তুতি
- মাদিনার ১০ বছর — রাষ্ট্র গঠন, যুদ্ধ, চুক্তি, শিক্ষা, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা
এই প্রতিটি ধাপেই আমাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা ও পথনির্দেশ।
কেন রাসূল (সা.)-এর জীবনী জানা জরুরি?
১. আখলাক ও নৈতিকতার শিখর তিনি
তাঁর চরিত্র সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
“وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ”
“নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।” (সূরা আল-কলম, আয়াত ৪)
রাসূল (সা.) কখনো কাউকে কষ্ট দেননি, মিথ্যা বলেননি, কারো অধিকার হরণ করেননি। তাঁর দৃষ্টিতে গরিব, দাস, নারী, শিশু—সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী। এমন উত্তম চরিত্র অনুকরণ ছাড়া সমাজে সত্যিকার শান্তি আসতে পারে না।
২. ইসলামের মূল শিক্ষা বুঝতে সহায়ক
কুরআন নাজিল হয়েছে রাসূল (সা.)-এর জীবনে। তাঁর জীবন ছিল কুরআনের প্রতিফলন। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন:
“তাঁর চরিত্র ছিল কুরআন।” (সহীহ মুসলিম)
অতএব, কুরআন বুঝতে চাইলে রাসূল (সা.)-এর জীবনী জানা অপরিহার্য।
৩. দাওয়াহ ও নেতৃত্বের অনন্য দৃষ্টান্ত
তিনি ছিলেন:
- একজন পরিপূর্ণ দাওয়াতদাতা
- একজন কৌশলী কূটনীতিক
- একজন ন্যায়পরায়ণ বিচারক
- একজন সহানুভূতিশীল বন্ধু
- একজন রাহমাতুল লিল আলামিন
তাঁর নেতৃত্বে মদীনায় একটি সম্পূর্ণ ইসলামি রাষ্ট্র গঠিত হয়। আজকের মুসলিম বিশ্বকে যদি নেতৃত্বের সংকট থেকে উদ্ধার করতে হয়, তাহলে রাসূল (সা.)-এর রাষ্ট্রীয় নীতিমালা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
৪. পরিবার ও সামাজিক জীবনে আদর্শ
তিনি একজন প্রেমময় স্বামী, দায়িত্ববান বাবা, ও সদয় প্রতিবেশী ছিলেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় কিভাবে—
- স্ত্রীকে সম্মান করতে হয়
- সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হয়
- প্রতিবেশীর হক আদায় করতে হয়
- গরীব ও মিসকিনের পাশে দাঁড়াতে হয়
৫. সমকালীন সমস্যার সমাধান
বর্তমান দুনিয়ায় যখন মানুষ ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে, তখন রাসূল (সা.)-এর জীবনই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় জবাব। তিনি নারী-পুরুষের মর্যাদা রক্ষা করেছেন, ধর্মীয় সহনশীলতা দেখিয়েছেন, সংখ্যালঘুদের অধিকার দিয়েছেন।
রাসূল (সা.)-এর জীবনী কীভাবে পড়া উচিত?
- সত্যনিষ্ঠ, প্রামাণ্য গ্রন্থ থেকে পড়া জরুরি
- যেমন:
- ইবনে হিশাম এর “সীরাতুন্নবী”
- ইবনে কাসিরের “আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া”
- আধুনিক ভাষায়: “আর রাহীকুল মাখতুম” – সাফিউর রহমান মুবারকপুরী
- বিষয়ভিত্তিকভাবে জীবন বিশ্লেষণ করা যেমন: নেতৃত্ব, যুদ্ধনীতি, নারী সম্মান, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন কেবল মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য এক জীবন্ত আলোকবর্তিকা। তাঁকে ভালোবাসা ও অনুসরণ করাই প্রকৃত ঈমানের পরিচায়ক।
আল্লাহ বলেন:
“বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমাকে অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩১)
সুতরাং, রাসূল (সা.)-এর জীবনী জানা, বুঝা, এবং তা জীবনে প্রয়োগ করাই একটি মু’মিনের জন্য শ্রেষ্ঠ সফলতার পথ।