“যে আল্লাহকে ভালোবাসে, সে কোনো কষ্টে কষ্ট পায় না; যে আল্লাহর দিকে ফিরেছে, তার জন্য কিছু হারানো হারানো নয়।”
— ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (رحمه الله)
এই মহান উক্তিটি ইসলামী আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে। এটি একাধারে আত্মার প্রশান্তি, ধৈর্য, ও অন্তরজাত শান্তির উৎস। ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আত্মশুদ্ধির আলিম ছিলেন। তাঁর এই কথায় লুকিয়ে আছে একজন মুমিনের অন্তরের পরিপূর্ণ তৃপ্তি ও আল্লাহর উপর একান্ত ভরসার প্রতিচ্ছবি।
“যে আল্লাহকে ভালোবাসে…” – ভালোবাসার প্রকৃতি
ইসলামে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা শুধুমাত্র আবেগ নয়; এটি ঈমানের একটি অপরিহার্য স্তম্ভ। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সর্বাধিক ভালোবাসে।”
এ ভালোবাসা কেবল ইবাদতে নয়, জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে, অনুভূতিতে, লক্ষ্য ও বাসনায় পরিলক্ষিত হয়।
“সে কোনো কষ্টে কষ্ট পায় না…” – ব্যথার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন
যখন মানুষ আল্লাহকে ভালোবাসে, তখন সে দুনিয়ার কষ্টকে ‘শাস্তি’ নয় বরং ‘পরীক্ষা’ মনে করে। এমন মানুষ জানে:
-
দুঃখ এলে সেটি আল্লাহর পক্ষ থেকে তার ঈমান পরীক্ষা
-
দুনিয়ার কষ্ট আখিরাতের পুরস্কারের সোপান
ফলে কষ্ট থেকেও সে শান্তি পায়, কারণ সে জানে—আল্লাহ তার পাশে আছেন।
সাহাবীদের উদাহরণে এটি স্পষ্ট
সাহাবীরা যুদ্ধ, হিজরত, পরিবার ত্যাগ—সবকিছু করেছেন কেবল আল্লাহর ভালোবাসার জন্য। কিন্তু তাঁরা কষ্ট পাননি, কারণ তাদের হৃদয় পরিপূর্ণ ছিল আল্লাহর মহব্বতে।
উদাহরণস্বরূপ:
-
বিলাল (রাঃ)—তাকে লোহার চেইনে বেঁধে রোদে ফেলে দেওয়া হতো, তবুও বলতেন: “আহাদ, আহাদ!”
-
এ কষ্ট শরীরে হলেও আত্মা ছিল আনন্দিত।
আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে
যে আল্লাহকে ভালোবাসে:
-
সে দুনিয়ার লালসাকে ত্যাগ করে
-
অপমানকে ধৈর্যের পরীক্ষায় রূপ দেয়
-
কঠিন সময়েও আল্লাহর রহমত দেখে
-
ব্যর্থতায় কষ্ট না পেয়ে তাওফিকের আশা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা মানেই ‘নাজাতের পথ’
“যে আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছে, তার কিছু হারানো হারানো নয়।”
ইবনুল কাইয়্যিম এখানে বুঝাতে চেয়েছেন—তুমি যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কিছু ত্যাগ করো, তবে সেটি প্রকৃত অর্থে ‘হারানো’ নয়, বরং বড় পাওয়ার পথ।
-
কেউ হারাম ইনকাম ছেড়ে দেয় → দুনিয়ার আরাম হয়তো কমে, কিন্তু অন্তর শান্ত হয়
-
কেউ হারাম সম্পর্ক থেকে ফিরে আসে → সে হয়তো একাকী হয়, কিন্তু আল্লাহর কাছাকাছি হয়
আল্লাহর দিকে ফিরে আসার অর্থ কী?
-
তাওবা করা
-
নামাযে ফিরে আসা
-
নিজের জীবন লক্ষ্যকে আখিরাতমুখী করা
-
অন্তরের কিবলা ঠিক করে নেওয়া
কেউ যদি এমনভাবে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, তবে সে প্রকৃত ‘রেজাল’ (আল্লাহর বন্ধু) হয়ে যায়।
হারানোর ভয় কেবল দুনিয়াপ্রেমীদের হয়
দুনিয়াকে ভালোবাসলে:
-
ক্ষতি হলে কান্না আসে
-
হারালে আফসোস হয়
-
অপমান হলে অন্তর ভেঙে পড়ে
কিন্তু যারা আল্লাহকে ভালোবাসে, তারা জানে:
“আমি যদি আল্লাহকে না হারাই, তবে কিছুই হারাইনি।”
যারা কিছু হারিয়ে আল্লাহকে খুঁজে পায়—তাদের জন্যই প্রকৃত সফলতা
ইতিহাসের বহু বড় ব্যক্তি:
-
সব হারিয়ে আত্মবিশ্বাস হারাননি
-
বরং সেই হারানোর মধ্য দিয়েই আল্লাহর দিকে মনোযোগী হন
সেই মুহূর্তেই আসে ‘আল্লাহর দয়া ও রহমত’।
কষ্টের মুহূর্তে আল্লাহর ভালোবাসা সবচাইতে বেশি প্রকাশ পায়
যখন দুনিয়ার সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয়, যখন নিজের মন ভেঙে পড়ে, যখন কেউ পাশে থাকে না— ঠিক তখনই আল্লাহ বলেন:
“আমি তোমার খুব কাছাকাছি আছি।”
এই উপলব্ধিই মানুষকে সত্যিকারের শোকরগুজার বানায়।
উপসংহার: অন্তরের তৃপ্তির আসল ঠিকানা—আল্লাহর ভালোবাসা
সবাই চায় সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা, সফলতা। কিন্তু তা অর্জিত হয় না অর্থ, সম্পর্ক, বা খ্যাতির মাধ্যমে।
আসল শান্তি আসে তখনই, যখন মানুষ আল্লাহকে ভালোবাসে এবং তাঁর দিকে ফিরে আসে।
তাই ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) এর এই কোটেশন হলো এমন এক তাওহীদের ডাক, যা অন্তরের গভীরে আলো জ্বালিয়ে দেয়।
❝তুমি যদি আল্লাহর প্রেমে হৃদয় ভরাও, তাহলে হারানো মানে হবে না কোনো ক্ষতি; বরং তুমি সেই প্রেমেই খুঁজে পাবে পৃথিবী ও আখিরাতের পূর্ণতা।❞